আমেরিকার স্বাধীনতা

আমেরিকার স্বাধীনতা

বাটব্যাল স্যার: অ্যাই কাবলা! বল তো দেখি, আমেরিকা কবে স্বাধীন হয়েছিল?

কাবলা: (যেন লটারি পেয়েছে এমন ভাব করে তড়াক করে সোজা হয়ে বসে) ওহ! এ তো আমার বাঁ হাতের খেল, স্যার! ফোর্থ জুলাই! আরে, আমার মাসতুতো দাদা বিল্টুদা ওখানে থাকে যে! সে কী ইনস্টা রিল দিয়েছিল সেদিন আমেরিকান ফ্ল্যাগ নাড়িয়ে! হে হে, সব খবর রাখি স্যার!

বাটব্যাল স্যার: (একটু মুচকি হেসে, আবার পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে) হুমম্! বিল্টুর রিল দেখে জ্ঞানলাভ করেছিস! তা তারিখটা ঠিকই বলেছিস – ১৭৭৬ সালের ৪ঠা জুলাই। কিন্তু ওটা শুধু রিল দেওয়ার দিন নয় রে বোকা! এর পেছনে আছে অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, অনেক লড়াইয়ের গল্প! যাকে বলে আমেরিকান বিপ্লব (The American Revolution) বা মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধ (The U.S. War of Independence)। ওই যুদ্ধের পরেই কিন্তু আমেরিকা ব্রিটিশদের থেকে মুক্তি পেয়েছিল।

কাবলা: (চোখ গোল গোল করে) বলেন কী স্যার! যুদ্ধ? তার মানে ওরাও আমাদের মতো করে ব্রিটিশদের পাল্লায় পড়েছিল? ইস্! আমাদের যেমন পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিল, সিরাজদ্দৌলা হেরে গিয়েছিল... ওদেরও কি ওইরকম ব্রিটিশদের সাথে লড়াইয়ের কেস?

বাটব্যাল স্যার: আরে না না! এখানেই তো মজাটা! ওদের স্বাধীনতার গল্পটা আমাদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। এটা ঠিক স্থানীয় বাসিন্দা বনাম ব্রিটিশ লড়াই ছিল না। বরং, ওই যে ১৩টা ব্রিটিশ কলোনি ছিল, যারা আসলে ব্রিটিশরাই ছিল বা তাদের বংশধর, তারাই প্রায় দেড়শো বছর ধরে ওখানে থাকার পর খোদ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধেই লড়েছিল স্বাধীনতার জন্য! সত্যি বলতে কি, আমেরিকার যারা আসল আদি বাসিন্দা, মানে নেটিভ আমেরিকানরা, তাদের বেশিরভাগই কিন্তু ওই যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ছিল আর তাদের সাহায্যও করেছিল!

কাবলা: (মাথায় হাত দিয়ে, ভুরু কুঁচকে) অ্যাঁ! বলেন কী স্যার? নিজের দেশের লোক নিজের দেশের সরকারের বিরুদ্ধে লড়েছে... আবার আমেরিকার আসল লোকগুলো ব্রিটিশদের দিকে? এ তো সব কেমন ঘুলিয়ে যাচ্ছে! আমার কান ভোঁ ভোঁ করছে! একটু ঝেড়ে কাশুন তো স্যার... মানে, পরিষ্কার করে বলুন...

বাটব্যাল স্যার: হ্যাঁ কাবলা, ঠিকই ধরেছিস। ব্যাপারটা একটু গোলমেলে লাগতেই পারে। শোন তবে...

(বাটব্যাল স্যার একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন, যেন ক্লাসের সবচেয়ে জরুরি পড়াটা পড়াচ্ছেন। কাবলার চোখেমুখে এখনো বিস্ময় আর প্রশ্ন!)

বাটব্যাল স্যার: দ্যাখ, ওই যে ১৩টা কলোনি ছিল, সেগুলো তো রাতারাতি গজিয়ে ওঠেনি। প্রায় দেড়শো বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছিল। সেখানকার লোকজন, মানে যারা মূলত ব্রিটেন থেকেই ওখানে গিয়েছিল, তারা নিজেদের মতো করেই শাসন চালাচ্ছিল, ব্যাবসা করছিল। লন্ডনে বসে থাকা ব্রিটিশ সরকার প্রথমদিকে খুব একটা মাথা ঘামাতো না। অনেকটা যেন হোস্টেলের ছেলেদের মতো, ওয়ার্ডেন একটু দূরে থাকলে যেমন নিজেদের রাজত্ব চালায়!

কাবলা: (হাঁ করে শুনছে) হুঁ হুঁ... তারপর?

বাটব্যাল স্যার: কিন্তু তারপর হল কী, ১৭৫০-৬০ সাল নাগাদ ব্রিটিশরা ফরাসিদের সাথে এক বিরাট যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল, যেটাকে বলে 'সেভেন ইয়ার্স ওয়ার' বা সাত বছরের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে ব্রিটিশরা জিতল বটে, কিন্তু তাদের ভাঁড়ার প্রায় শূন্য! তখন তাদের নজর পড়ল আমেরিকার ওই কলোনিগুলোর ওপর। ভাবল, 'এদের রক্ষা করার জন্য এত খরচ হল, এবার এদের কাছ থেকেই সেটা উশুল করতে হবে!'

কাবলা: (চট করে বলে ওঠে) ওহ! এইবার বুঝেছি! অনেকটা যেমন আমরা ক্লাসে চাঁদা তুলি পিকনিকের জন্য! কিন্তু স্যার, ওরা চাঁদা দিতে রাজি হল না কেন?

বাটব্যাল স্যার: আরে চাঁদা বলিস না! চাঁদা তো তাও লোকে খুশি হয়ে দেয়। ব্রিটিশ সরকার একের পর এক ট্যাক্স বসাতে শুরু করল – চিনির ওপর ট্যাক্স, কাগজের ওপর স্ট্যাম্প ডিউটি ট্যাক্স, চায়ের ওপর ট্যাক্স! যেগুলোর নাম হল সুগার অ্যাক্ট, স্ট্যাম্প অ্যাক্ট, টাউনসেন্ড অ্যাক্টস, টি অ্যাক্ট ইত্যাদি। কিন্তু আসল গোলমালটা বাধল অন্য জায়গায়। কলোনির লোকেরা বলল, 'বেশ তো, ট্যাক্স দেবো। কিন্তু লন্ডনের পার্লামেন্টে আমাদের কথা বলার লোক কই? আমাদের কোনো প্রতিনিধিই তো নেই ওখানে! আমাদের মতামত না নিয়েই তোমরা যা খুশি ট্যাক্স বসিয়ে দেবে, এটা কেমন বিচার?' এই যে কথাটা – ‘No taxation without representation’ – এটাই হয়ে উঠল তাদের মূলমন্ত্র।

কাবলা: বাপরে! তার মানে, আমাদের ভোট দেওয়ার অধিকার না থাকলে আমরা যেমন পঞ্চায়েত বা মিউনিসিপ্যালিটির কোনো সিদ্ধান্ত মানতে চাইব না, সেরকম?

বাটব্যাল স্যার: একদম! ঠিক ধরেছিস। শুধু ট্যাক্স নয়, ব্রিটিশ সরকার আরও নানা নিয়মকানুন চাপাতে লাগল। যেমন, তারা হুকুম জারি করল যে কলোনির লোকেরা শুধু ব্রিটিশ জাহাজেই মালপত্র আনা-নেওয়া করতে পারবে, অন্য কোনো দেশের সাথে সরাসরি ব্যবসা করতে পারবে না। আবার, ব্রিটিশ সৈন্যদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও কলোনির লোকদেরই করতে হবে! এই সবকিছু মিলিয়ে কলোনির লোকজনের মনে ক্ষোভ জমতে শুরু করল। তারা ভাবল, ‘দূর ছাই! আমরা এখানে খেটেখুটে নিজেদের জায়গা তৈরি করেছি, আর ওরা লন্ডনে বসে আমাদের ওপর খবরদারি করবে? এ তো ভারী অন্যায়!’

কাবলা: (উত্তেজিত হয়ে) তারপর? তারপর কী হল স্যার? লেগে গেল নাকি ধুন্ধুমার?

বাটব্যাল স্যার: হ্যাঁ, ঠিক তাই। আস্তে আস্তে বচসা বাড়ল, ছোটখাটো সংঘর্ষ শুরু হল। বোস্টন শহরে একবার ব্রিটিশ সৈন্যদের গুলিতে কয়েকজন সাধারণ মানুষ মারা গেল (বোস্টন ম্যাসাকার), আবার কলোনির লোকেরা রেগে গিয়ে জাহাজের সব চা সমুদ্রে ফেলে দিল (বোস্টন টি পার্টি)। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে দু'পক্ষের মধ্যে আর মিটমাট হওয়ার উপায় রইল না। তখন কলোনির নেতারা একসঙ্গে বসে ঠিক করলেন – আর ব্রিটিশদের অধীনে থাকা নয়, এবার তারা নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করবে। কিন্তু ব্রিটিশরা কি আর সহজে ছেড়ে দেয়? শুরু হল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ – একদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিশাল সেনাবাহিনী, আর অন্যদিকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা আমেরিকার কলোনিগুলোর সাধারণ মানুষ আর তাদের নিজস্ব সেনাদল। অবশেষে ১৭৭৬ সালের ৪ঠা জুলাই যুধ্যে জিতে তারা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সই করল।

কাবলা: (চোখ বড় বড় করে) বাবাঃ! তার মানে ব্রিটিশরাই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছিল আমেরিকার স্বাধীনতার জন্য! এবার পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হল স্যার! অনেকটা যেন... বাড়ির বড় ছেলে বাবার শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আলাদা সংসার পাতার মতো! হে হে!

বাটব্যাল স্যার: (হেসে) হা হা! তুই বেশ মজার উদাহরণ দিস তো কাবলা! হ্যাঁ, মোদ্দা কথা অনেকটা তাই। এইভাবেই অনেক লড়াই, অনেক আত্মত্যাগের পর আমেরিকা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা অর্জন করেছিল।

About the Author

সুশোভন